পিছিয়ে পড়া জাতির সমাজ সংস্কারের জন্য সাহিত্য এবং বিজ্ঞানের গুরুত্ব - সুদর্শন চাকমা | Hill Science Society

সম্প্রতি যদ্যপি আমার গুরু বইটি পড়ছি। অসাধারণ বই। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল, কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি তাদের অবশ্যই এই বইটি পড়া উচিত। বইটিতে আব্দুল রাজ্জাক স্যার আহমদ ছফাকে অসাধারণ একটি কথা বলেছিলেন। কথাটি ঠিক এরকমি। একটি জাতিকে জানার জন্য অবশ্যই দুইটা জিনিসের জানা প্রয়োজন। ১.তারা কী খায়? ২.তারা কি পড়ে/কি চিন্তা করে? এই দুই জিনিসের উপর ভিত্তি করে যদি আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে তাকাই তাহলে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই আমরা কোন খাদের কিনারাই দাড়িয়ে আছি। আমাদের এতো প্রান্তিকতা চিন্তা ভাবনা,সমাজের কূপমন্ডুকতা একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা সমসাময়িক সময় থেকে হাজার হাজার বছর পিছিয়ে আছি। এর প্রধান কারন শিক্ষার অভাব। আমরা এখনো পাহাড়ে প্রান্তিকতা মানুষের কাছে শিক্ষার বার্তা পৌছাতে পারেনি।


একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এর দায় আমার উপর বর্তায়।তার চেয়ে বেশি সরকার,পাহাড়ের জনপ্রধিনিত্বমূলক রাজনৈতিক দল এবং সমাজের উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত শিক্ষিত এবং বুদ্ধিজীবী মানুষের উপর বর্তায়।পাহাড়ে সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্য অবশ্যই শিক্ষা প্রয়োজন।একজন মানুষের আক্ষরিক জ্ঞান না থাকলে সে কি করে সাহিত্য বা বিজ্ঞান বুঝবে।সভ্যতা ক্রমবিকাশে বা সভ্যতা শুরুর দিকে মানুষ যখন সবেমাত্র দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করা শুরু করতে লাগল তখন থেকেই সমাজের উৎপত্তি। এই সমাজ থেকে মানুষের বৈপ্লবিক চিন্তা,সভ্যতার আধুনিকতা এবং রাষ্ট্রের রূপলাভ করে।ধীরে ধীরে সমাজের মানুষের প্রয়োজনে দর্শন,রাজনীতি,বিজ্ঞান আসল।তাই একটি জাতির পরিবর্তনের মূল জায়গা সমাজ।একটি জাতিকে জ্ঞান বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করার জন্য সমাজের একদম তৃনমুল পর্যায় হতে কাজ করতে হবে।সমাজের তৃনমূল ফাউন্ডেশনটি শক্তিশালী না হলে একটি জাতির উন্নতি বা সমাজ বিপ্লবের চিন্তা মাথায় আনা যায় না।

এবার আসা যাক,সমাজ পরিবর্তনে সাহিত্য এবং বিজ্ঞানের গুরুত্ব।সাহিত্য হলো সিমের কম্বো প্যাকের মত।সাহিত্য একসাথে বিজ্ঞান, দর্শন,সমাজব্যবস্থা,রাজনীতি এবং অর্থনীতি জড়িত থাকে।সমাজ সদা পরিবর্তনশীল।ভৌগোলিক জায়গা অনুসারে সমাজ কোথাও ধীরে কোথাও দ্রুত পরিবর্তন ঘটে।জীবনের মতো করে সমাজ একই মাপে পরিবর্তন ঘটে না।এই ভৌগলিক তারমত্য এবং সমাজব্যবস্থা অমিলের কারনে ইউরোপের সাহিত্য সাথে উপমহাদেশের সাহিত্য অমিল রয়েছে।সাহিত্য একটি জাতির প্রতিনিধিত্বমূলক দর্পন হিসেবে কাজ করে।এই সাহিত্য মাধ্যমে একটি জাতির সমাজভাবনা,রাজনীতি চেতনা,প্রযুক্তির ধাবমানতা সম্পর্কে জানতে পারি।সময়ের বহমানতা স্রোতে সাহিত্য ইতিহাসে নবরূপতা লাভ করে।

সমাজ পরিবর্তনের করার আগে আপনাকে জানতে হবে সমাজের সিস্টেমিক ম্যাগানিজম আর সমাজের বসবাসরত মানুষেরা কি চিন্তা করছে।এর জন্য অবশ্যই সাহিত্য প্রয়োজন।আমাদের পাহাড়ে সমাজ ব্যবস্থা জানার জন্য আমাদের জানতে হবে সমাজের মানুষেরা কি চিন্তা করছে।সমাজের সীমাবদ্ধতা,কূপমন্ডুকতা জানতে হবে।যদি বাংলা সাহিত্য শরৎচন্দ্র সমাজের কূপমন্ডুকতা, সমাজের ত্রুটি এবং রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে কথা না বলতেন তাহলে বাংলা উপমহাদেশে হিন্দু সমাজব্যবস্থার এতো দ্রুত পরিবর্তন ঘটতো না।সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন জন্য অবশ্যই আমাদের কমপক্ষে একশ -দুইশ বছরের ইতিহাস সংস্কৃতি জানতে হবে।বর্তমান সময় থেকে পশ্চাৎমুখী হয়ে দুইশত বছরে ফিরে গিয়ে আমাদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা দরকার।জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস,জাতির চিন্তার পরিবর্তন,সময়ের বহমানতায় সমাজ ব্যবস্থা কি করে পরিবর্তন  হল এই সবের ইতিহাস জানা না থাকলে একটি জাতির সমৃদ্ধশালী ইতিহাস রচনা করা যায় না।জাতির ক্ষত চিহ্নিত করতে না পারলে জাতির পরিবর্তনের বিকাশ সম্ভব নই।আপনারা রুশ বিপ্লব আর চীন বিপ্লবের ক্ষেত্রে খেয়াল করলে দেখবেন সাহিত্য এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কাঠামো কতটা অবদান ছিলো।এই দুটি বিপ্লব সমাজতান্ত্রিক উপায়ে সংগঠিত হলেও বিপ্লবের ধরন দুটোই আলাদা ছিলো।কারন দুটি দেশের ভৌগলিক,ভাষা এবং সংস্কৃতির তারমত্য।দেখুন লেলিন এবং মাও উভয়েই মার্ক্সবাদী।মাক্সের তত্ত্ব তারা উভয়ের গ্রহন করেন।কিন্তু মাক্সের তত্ত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা উভয় নিজস্ব সংস্কৃতি,জনগনের রুবিবোধ বা চাহিদা,সমাজব্যবস্থা ভিত্তিতে সেটা প্রয়োগ করেন।এখানে সাহিত্য অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িত।সুতরাং লেলিনের যে ধারাই বিপ্লব সংগঠিত করেছেন সেটা বাস্তবতা নিরিক্ষে চীন বা পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্ভব নই।এর জন্য আমাদের সাহিত্যটা অনেক জরুরি।সাহিত্য সমৃদ্ধ না হলে সমাজ পরিবর্তন কল্পনা করা সম্ভব নয়।সুতরাং লেলিনবাদ,মাক্সবাদ,মাওবাদ সমাজ বিপ্লবের জন্য যথেষ্ট নয়।এর জন্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে গবেষনা বা পড়াশোনা করা দরকার। মানুষের চিন্তাভাবনা সাথে পরিচিত হওয়া দরকার।

আর বিজ্ঞানের কাজটা হলো সাহিত্য মাধ্যমে সমাজের রোগ বা ক্ষত চোখে পড়লে সেটা বিজ্ঞান দিয়ে দূর করা।বিজ্ঞান মানুষকে যুক্তিবাদী করে তোলে।বিজ্ঞান এবং সাহিত্য মানুষের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করে এবং মানুষদেরকে মানবিক গড়ে তোলে।সমাজের কূপমন্ডুকতা, কুসংস্কার দূরীকরণে বিজ্ঞান প্রয়োজন।

লিখেছেন- সুদর্শন চাকমা, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Comments

  1. সুন্দর হয়েছে দাদা।
    আমি আপনার থেকে অনেক কিছু শিখেছি আর ভবিষ্যৎতেও শিখবো।❤️

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ

    ReplyDelete
  3. ভবিষ্যতে এমন আরো অনেক লেখনি আমরা আশা করি।

    ReplyDelete

Post a Comment