বর্তমান প্রেক্ষিতে আমাদের সমাজের গবেষক ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা - তিষ্য চাকমা

 


গত ২০১৯-২০ সালে করোনা মহামারীর ভয়াল সময়ের কথা আমাদের কথা সকলেরই মনে আছে।কোভিড-১৯ এর কবলে পড়ে আমাদের বিশ্বরাজনীতি,অর্থনীতি,রাষ্ট্রব্যবস্থা,সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে হিমশিম খেতে হয়েছিল।তখনকার সময়ে প্রতিষেধক তৈরি থেকে শুরু করে সমাজব্যবস্থাকে পুনরায় দাঁড় করিয়ে আনতে গবেষনা ও গবেষকদের প্রয়োজনীতা হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ গোটাঁ বিশ্ব।

সুতরাং, যেখানে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্র গুলোর হিমশিম অবস্থা, সেখানে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অল্প সংখ্যার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য কতটা ভয়ংকর অবস্থা হতে পারে?

একটি সমাজে যদি গবেষক না থাকে,তাহলে সেই সমাজের অভ্যন্তরীন বিষয়গুলো কিংবা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধানের আলো দেখবে না।কারণ গবেষক ছাড়া নতুন ধারণা ও তত্ত্ব  পাওয়া অসম্ভব।আর গবেষণার জন্য ব্যক্তিকে আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য থাকতে হয় না,নিজের দক্ষতা অনুযায়ী পছন্দমত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে গবেষণা প্রকাশ করতে পারে।আবার পৃথিবীর সকল প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা সমূহ পরিচালিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ গুলোতে।অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ শুধুমাত্র মুখস্থনির্ভর পড়ালেখা কিংবা ডিগ্রীধারী হওয়া আমাদের যুগোপযোগী নয়।

এই যে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের প্রাচীন কাল থেকে কিছু প্রথা রয়েছে যেগুলোর সাথে কোনো বৈজ্ঞানিক কিংবা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও কোনো প্রকারের সম্পর্ক নেই।যেমন চাকমা সমাজে মাথা ধোঁয়া নামের একটি প্রথা আছে।যেই প্রথায় মাথা ন ধুলে নাকি গোষ্ঠীর সকলকে বাঘ খেয়ে নিবে! বাস্তবিকপক্ষে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে মেছো বাঘ ছাড়া তেমন কোনো বড় বিড়াল প্রজাতির বাঘের অস্তিত্ব আর নেই।

সুতরাং এসব ভ্রান্ত ধারণা গুলো নিয়ে আমাদের সমাজে ঠিক একটা গবেষণা কিংবা বৈজ্ঞানিক ব্যাখা দেওয়ার মতো ব্যাক্তি আমাদের সমাজে খুব নগন্য।হ্যাঁ,একটি বিষয় সত্য দিন দিন শহুরে এলাকায় অনেকাংশে এটি কমে এসেছে, তবুও এসব বিষয়ে লেখালেখি কিংবা সমাজের প্রত্যেককে বিষয় গুলো বিশ্লেষণ করার মতো জনবল গড়ে উঠে নি আমাদের।আবার আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে আমাদের গবেষণা হতে হবে বিজ্ঞাননির্ভর এবং বাস্তবমুখী চিন্তাভাবনার।গবেষনাধর্মী শিক্ষাব্যবস্থার সাথে আমরা যতটা না গুরুত্বারোপ করি তার চেয়ে আমাদের চিন্তা গুলো এখনো একাডেমিক লেভেলে বদ্ধ থেকে যায় এবং আমাদের সমাজব্যবস্থায় ক্যারিয়ার ফোকাশিং বিষয়কে কেন্দ্র করে বেশি সীমাবদ্ধ হতে শেখায়।যার ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের মধ্যে হীনমন্যতা এবং গবেষণা ধর্মী শিক্ষা থেকে আমরা আলাদা হতে থাকি।তাই সামাজিক ব্যবস্থার উপর ও আমাদের গবেষণার ঘাটতি রয়েছে বলা চলে।

যদি এখন আমি সমাজের উপর গবেষণার কথা বলি তবে পি.ভি ইয়ং এর মতবাদকে তুলে ধরতে পারি।তার মতবাদ অনুসারে,“সামাজিক গবেষণাকে একটি বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে; যৌক্তিক ও নিয়মতান্ত্রিক কৌশল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে যার লক্ষ্য হলো- ১. নতুন তথ্য উদঘাটন বা পুরাতন তথ্য যাচাই করা; ২. উপযুক্ত তাত্ত্বিক কাঠামো অনুসরণে এদের পারস্পরিক অনুক্রম, আত্মসম্পর্ক এবং কার্যকরণ সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা; ৩. নির্ভরযোগ্য ও যথার্থ মানব আচরণ অধ্যয়নের সুবিধার্থে নতুন বৈজ্ঞানিক হাতিয়ার, প্রত্যয় ও তত্ত্ব উন্নয়ন করা।” 

অর্থাৎ প্রতিপদক্ষেপে আমাদের এই চিন্তাধারা থাকা উচিত আমাদের গবেষণা যেন তাত্ত্বিকভাবে সমাজে গ্রহনযোগ্যতা লাভ করে।আরেকটি বিষয় হলো বর্তমান বিশ্বে যেখানে গবেষণা খাত এবং নতুন জিনিসের খোঁজে, আমরা এখনও আমাদের অর্থনৈতিক সহাবস্থান, সামাজিক দায়বদ্ধতা,পারিবারিক সমস্যা এসব থেকে সরে আসতে পারিনি।তাই আমার মতে এই সময়ে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম থেকে গবেষক হিসেবে গড়ে উঠা একটা বিরাট বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।সুতরাং এসব বাঁধা-অন্তরায়কে প্রতিহত করে আমাদের সামনে অগ্রসর হতে হবে।আমাদের এই পার্বত্য চট্টগ্রামে গবেষণার অনেক স্কোপ তৈরি হয়েছে,কিন্তু তৈরি হয়নি গবেষণা কিংবা গবেষক তৈরির মতো পরিবেশ।যার কারণে প্রতিক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়ছি, আমাদের জাতিসত্তাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে।

এসব বিষয়গুলোকে কাটিয়ে উঠে পাহাড়ের সামগ্রিক স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে,সাথে গবেষক হয়ে উঠার মতো অবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন।তবেই পাহাড়ের বিদ্যমান সমস্যা গুলো অচিরেই কাটিয়ে উঠতে পারবো আর এর মধ্যেই প্রতীয়মান হয়ে উঠে যে গবেষকের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু!

Comments